বাংলাদেশ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি মামলার একটি বড় অংশ হল 'আঘাত' জনিত মামলা। অর্থাৎ, পেনাল কোড, ১৮৬০ এর ধারা ৩২৩, ৩২৪, ৩২৫ এবং ৩২৬ এর অধীনে অপরাধ। যখন কোন বিবাদের জন্য মারামারি হয়, তখন বাদীকে সাধারণত ধারা ২৬ (অর্থাৎ দণ্ডবিধির ৩২৬ ধারা) এর অধীনে মামলা করতে দেখা যায়। এর প্রধান কারণ হল, আঘাত সংক্রান্ত সব মামলার মধ্যে এই ধারায় শাস্তি বেশি।কোন ব্যক্তিকে ৩২৬ ধারার অভিযোগে হাজতে পাঠানো হলে আসামীমে কমপক্ষে ১ মাস হাজতে থাকতে হবে। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষ এর চেয়ে বেশিও হতে পারে।
জ্ঞাতব্য যে, এই ধারার অপরাধা আমলযোগ্য (Cognizable offence) এবং সমনযোগ্য; জামিনযোগ্য নয়। এমনকি আপোষযোগ্য নয়। তাই ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন হয় না; বরং দায়রা আদালত বা হাইকোর্ট থেকে জামিন নিতে হয়।
আঘাত ও গুরুতর আঘাত কি?
বাংলাদেশে বর্তমান প্রচলিত দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩১৯ ধারায় আঘাতের (Hurt) এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-
Whoever causes bodily pain, disease or infirmity to any person is said to cause hurt.
অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যদি অপর কোনো ব্যক্তির শারীরিক ব্যথা, রোগ বা দুর্বলতা সৃষ্টি করে, তাহলে সে ব্যক্তি আঘাত করেছে বলে বিবেচিত হবে। অত্র সংজ্ঞাতে প্রতীয়মান হয় যে, কেবলমাত্র দৈহিক যন্ত্রনা (Body pain), পীড়া (Disease) শারীরিক অসুস্থ্যতা বা অপারগতা (Infirmity) ঘটানোকে আঘাতের (Hurt) আওতাভূক্ত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, দণ্ডবিধির ৩২০ ধারাতে গুরুতর (Grievous Hurt) আঘাতের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। এই ধারা কেবল নিন্মোক্ত শ্রেণীসমূহের আঘাতকেই গুরুতর আঘাত বলে গণ্য করবে। যেমন-
(১) পুরুষত্বহীন করণ।
(২) স্থায়ীভাবে দুই চক্ষুর যে কোনটিতে দৃষ্টিশক্তি রহিত করণ।
(৩) স্থায়ীভাবে দুই কর্ণের যে কোনটির শ্রুতিশক্তি রহিত করণ।
(৪) যে কোন অঙ্গ বা গ্রন্থির অনিষ্টসাধন করণ।
(৫) যেকোন অঙ্গ বা গ্রন্থির কর্মশক্তিসমূহের বিনাশ বা স্থায়ী ক্ষতিসাধন করণ।
(৬) মস্তক বা মুখমণ্ডলের স্থায়ী বিকৃতিকরণ।
(৭) হাড় বা দণ্ড ভঙ্গ বা গ্রন্থিচ্যুতকরণ।
(৩) স্থায়ীভাবে দুই কর্ণের যে কোনটির শ্রুতিশক্তি রহিত করণ।
(৪) যে কোন অঙ্গ বা গ্রন্থির অনিষ্টসাধন করণ।
(৫) যেকোন অঙ্গ বা গ্রন্থির কর্মশক্তিসমূহের বিনাশ বা স্থায়ী ক্ষতিসাধন করণ।
(৬) মস্তক বা মুখমণ্ডলের স্থায়ী বিকৃতিকরণ।
(৭) হাড় বা দণ্ড ভঙ্গ বা গ্রন্থিচ্যুতকরণ।
(৮) যে আঘাত জীবন বিপন্ন করে বা আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ২০ দিন মেয়াদের জন্য তীব্র দৈহিক যন্ত্রণা দান করে বা তাকে তার সাধারণ পেশা অনুসরণ করতে অসমর্থ করে।
আঘাত ও গুরুতর আঘাতের শাস্তি বিধান
দণ্ডবিধির ৩২৩ ধারায় স্বেচ্ছাকৃতভাবে আঘাতের শাস্তির বিধান রয়েছে। স্বেচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করার জন্য এক বৎসরের কারাদণ্ড বা একহাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে। [কিন্তু এই ধারায় ৩৩৪ ধারায় বর্ণিত ক্ষেত্রে প্রয়োগকৃত আঘাতের জন্য দণ্ডের অবকাশ রাখে নাই।] কিন্তু এই ধারার অধীনে অপরাধ প্রমাণের জন্য নিন্মোক্ত উপাদান থাকতে হবে। যেমন- অপরিহার্য উপাদান থাকতে হবে। যথা:
- অভিযুক্ত ব্যক্তি বাদীকে আঘাত করেছে;
- আঘাতটি স্বেচ্ছাকৃতভাবে ছিল; এবং
- আঘাতটি দণ্ডবিধির ৩৩৪ ধারায় ব্যবস্থিত আঘাতের অনুরূপ নয়।
উদাহরণঃ
মেয়েদের চুল ধরে টানা, দৈহিক স্পর্শ দ্বারা কারো শরীরে পীড়া সঞ্চার করা ইত্যাদি। কিন্তু যদি রহিম, ক্রমাগত আজেবাজে কথা বলে করিমকে উস্কানি দেয় এবং করিম এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে রহিমকে আঘাত করে। এই ধরনের আঘাতের ক্ষেত্রে উক্ত আজেবাজে কথা ছুড়ে দেওয়া লোকটিরও কিছু দায় আছে। রহিম, করিমকে এমনভাবে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে যে, করিম রাগ সংবরণ করতে না পেরে রহিমকে মেরেছে। এক্ষেত্রে করিমের আঘাতটি নিরঙ্কুশভাবে ‘সেচ্ছাকৃতভাবে’ নয়; বরং তার আঘাতটি ঘটেছে প্ররোচনার (Provocation) দরুণ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ভোঁতা অস্ত্র দ্বারা যদি কেউ স্বেচ্ছাকৃতভাবে কাউকে আঘাত করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ৩২৩ ধারা অনুযায়ী মামলা দায়ের করা যাবে। আর যদি কেউ কোন ভোঁতা অস্ত্র দ্বারা স্বেচ্ছাকৃতভাবে কাউকে গুরুতর আঘাত (Grievous Hurt) করে, তবে সেক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে ৩২৫ ধারা অনুযায়ী মামলা দায়ের করা যাবে। আর যদি কেউ স্বেচ্ছায় কোনও ভোঁতা অস্ত্রের সাথে কাউকে মারাত্মক আঘাত (গুরুতর আহত) দেয় তবে তার বিরুদ্ধে ৩২৫ ধারায় মামলা করা হবে।
স্বেচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাতের শাস্তি বিধান দণ্ডবিধির ৩২৫ ধারাতে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা আছে যে, “কোন ব্যক্তি কাউকে স্বেচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাত প্রদান করলে তার শাস্তি হবে ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।”
ধারালো অস্ত্র দিয়ে স্বেচ্ছাকৃতভাবে কাউকে আঘাতের শাস্তির বিধান ৩২৪ ধারাতে উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ যদি স্বেচ্ছাকৃতভাবে কাউকে ধারালো অস্ত্র দ্বারা আঘাত করে, তবে ৩২৪ ধারা অনুযায়ী তার শাস্তি হবে ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ড।
আর দন্ডবিধির ৩২৬ ধারাতে ধারালো অস্ত্র দ্বারা স্বেচ্ছাকৃতভাবে কাউকে গুরুতর আঘাতের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এই ধারানুযায়ী স্বেচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাত দানকারী ব্যক্তির শাস্তি হবে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।
একদিকে, ৩২৩ ধারায় ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে আঘাতের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে, ৩২৫ ধারায় ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে মারাত্মক আঘাতের কথাও বলা হয়েছে। অর্থাৎ ৩২৩ এর অপরাধ ৩২৫ এ রূপান্তরিত হতে পারবে। যখন আঘাত গুরুতর আঘাত হয়ে যাবে, অপরাধটি ৩২৩ ধারা থেকে ৩২৫ ধারায় চলে যাবে।
অনুরূপভাবে, ৩২৪ ধারায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের কথা বলা হয়েছে। আবার ৩২৬ ধারায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে মারাত্মক আঘাতের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং ৩২৪ ধারার অপরাধ, ৩২৬ ধারায় রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগ আছে। অর্থাৎ যখন সাধারণ আঘাত, গুরুতর আঘাত হয়ে যাবে, ঠিক তখনই অপরাধটি ৩২৪ ধারা থেকে ৩২৬ ধারা হয়ে যাবে।
উদাহরণঃ
১. জলিল, কবিরকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তার এক পা ভেঙ্গে ফেলে।
২. আরাফাত ধারালো ছুরি দিয়ে জাফরের একটি পায়ের কিছুটা মাংস কেটে ফেলে।
উপরোক্ত দৃষ্টান্তদ্বয়ে আপাতদৃষ্টিতে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে একটি পা ভেঙ্গে ফেলাকে ধারালো ছুরি দিয়ে পায়ের কিছু মাংস কেটে ফেলার চাইতে গুরুতর মনে হতে পারে। তবে প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি তেমন নয়; বরং লাঠি যেহেতু ভোঁতা অস্ত্র, তাই এ ক্ষেত্রে আঘাতকারীর বিরুদ্ধে ৩২৫ ধারানুযায়ী মামলা দায়ের করা যাবে। অন্যদিকে, ছুরি ধারালো অস্ত্র হওয়ার কারণে আঘাতকারীর বিরুদ্ধে ৩২৬ ধারানুযায়ী মামলা দায়ের করা যাবে।
আরোও উল্লেখ্য যে, দন্ডবিধির ৩২৫ ধারায় আসামী কোন অপরাধ করলে আসামী অধিকার হিসেবে আদালতে জামিন চাইতে পারবে। যেহেতু এই ধারার অপরাধটি একটি জামিনযোগ্য অপরাধ, সুতরাং ৩২৫ ধারার অধীনে অনেক বড় বড় অপরাধ করেও অপরাধীগণ জামিন নিয়ে ছাড়া পেয়ে যায়।
অবশ্য আসামী জামিন নিয়ে যাতে ছাড়া পেতে না পারে সে জন্য আসামীর বিরুদ্ধে ৩২৫ ধারায় মামলা করার সময় ৩০৭ ধারাও জুড়ে দিতে হবে। তাহলে আসামী আর অধিকার হিসেবে জামিন চাইতে পারবে না। কেননা, তখন অপরাধটি অজামিনযোগ্য অপরাধ (Non-bailable offence) বলে গণ্য হবে।
দণ্ডবিধির ৩০৭ ধারানুসারে, খুনের উদ্যোগ (Attempt to Murder) নিয়ে কাউকে আঘাত করলে শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদন্ড অথবা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থদন্ড।
তবে বাংলাদেশে প্রায়শ দেখা যায় যে, যদি গুরুতর আঘাত মারাত্মক অস্ত্রের মাধ্যমেও না হয়, তবুও বাদী পক্ষ চাই ডাক্তার যেন লিখে আঘাত অস্ত্রের মাধ্যমে হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে ৩২৫ ধারা কে ৩২৬ ধারা করতে গিয়ে অনেকে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। ফলশ্রুতিতে, অধিকাংশ মামলাই চূড়ান্ত পর্যায় গড়ায় না।
Post a Comment
Post a Comment
To be published, comments must be reviewed by the administrator *