আমাদের এই উপমহাদেশে ১৭৯৩ সনে সর্বপ্রথম তামাদি আইন প্রণয়ন করা করা হয়। কিন্তু তখন এটি পূর্ণাঙ্গ আইন হিসেবে স্বীকৃতি পায় নি; বরং এটি খণ্ডকারে জারি করা হয়। পরবর্তিতে ১৮৫৯ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ আইনে পরিণত হয়। ১৮৯৯ সনে এটির সংশোধন আনা হয়। সর্বশেষ ১৯০৮ সনে আমাদের বর্তমান তামাদি আইনটি প্রণয়ন করা হয়।
১৯০৮ সালের তামাদি আইনে মোট ধারা ৩২ টি, তন্মধ্যে ৩ টি ধারা বাতিল করা হয়েছে। বর্তমানে ২৯ টি ধারা বলবৎ রয়েছে। তামাদি আইনে মোট ১৮৩ টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। মোট তফসিল ৩ টি (২য় ও ৩য় তফসিল) বাতিল করা হয়েছে। বর্তমানে ১ টি তফসিল বলবৎ আছে। বাদী এবং বিবাদীর আদালতের প্রতি স্বেচ্ছারিতা প্রতিরোধে মূলত এই আইনটি প্রণীত হয়েছিল।
তামাদি ও তামাদি আইনের সংজ্ঞা
সাধারণত, তামাদি বলতে বুঝায় সময়ের নির্দিষ্টতা। অন্যভাবে বলা যায়, একটি মামলার ঘটনা ঘটার কত দিনের মধ্যে মামলা করতে হয়। রায়ের পরবর্তী সময়ের কতদিনের মধ্যে আপিল করতে হয় এবং কতদিনের মধ্যে আবেদন করতে হয় এসবের নির্দিষ্টতাকেই বলা হয় তামাদি এবং তামাদি আইন হচ্ছে এমন একটি আইন যেখানে মামলা, আপিল বা আবেদন করার সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
সুতরাং তামাদি আইন বলতে এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আইনকে বুঝায় যা সকল প্রকার দাবী বা স্বত্বের দ্বন্দ্বকে নিরবচ্ছিন্ন বিস্তৃত বা দীর্ঘায়িত করার সুযোগ দেয় না; বরং তা চিরদিনের জন্য নিষ্পত্তি করতে সাহায্য করে এরুপ ব্যবস্থাকে তামাদি আইন বলে।
তামাদি আইনের প্রয়োজনীতা
তামাদি আইন, ১৯০৮ এর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যেমন-
- দেওয়ানী মামলা, আপিল এবং আদালতে কিছু দরখস্ত দাখিলের সময়কাল সম্পর্কিত আইন সংহত এবং সংশোধন করা হয়।
- দখল দ্বারা ব্যবহার স্বত্ব ও অন্যান্য সম্পত্তির অধিকার অর্জনের নির্ধারিত সময়সীমা প্রণয়ন করা হয়।
- তামাদি আইনের সময়সীমার দ্বারা বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে সামাজিক শান্তি বজায় রাখা হয়।
- মামলার দীর্ঘস্থায়ী প্রকৃতি পরিহার করে জনসাধারণের দুর্ভোগ লাঘব করা হয়।
- মামলার জটিলতা অর্থাৎ বহুগুণ বা সময় সাশ্রয় হয়।
- মামলার দীর্ঘসূত্রীতা বন্ধ করে অর্থের অপচয় রোধ করা হয়।
- প্রতারণামূলক কার্যকলাপ রোধ করা হয়।
- প্রতিষ্ঠিত অধিকার সংরক্ষণের জন্য সহায়তা করে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
- সর্বোপরি, তামাদি আইন প্রক্রিয়াটিকে দীর্ঘায়িত করার সুযোগ না দিয়ে সমস্ত ধরণের দাবি এবং মালিকানার দ্বন্দ্ব চিরতরে নিষ্পত্তি করতে সহায়তা করে।
তামাদি আইনের উদ্দেশ্য
তামাদি আইনকে বলা হয় শান্তির আইন, বিরামের আইন। তামাদি আইন স্বত্বের দ্বন্দ্বকে শান্ত করে, রোধ করে প্রতারণা। তামাদি আইন ধরে নেয় যে, দাবি যাঁর সত্য তিনি উহা আদায় করার জন্য তৎপর হবে। নাগরিকদের আইনের সাহায্য গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করাও এই আইনের একটি উদ্দেশ্য। এই আইন জনসাধারণকে সাহার্য করতে প্রস্তুত।যার কোন দাবি আছে তিনি আদালতের দারস্থ হবেন। অধিকার রক্ষায় কেউ ঢিলেমী করবেন ইহা কাম্য নয়। অর্থাৎ বিলম্ব ন্যায়বিচারে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
এই আইনে মোকদ্দমা রুজু করার সময়সীমা নির্দিষ্ট থাকায় মানুষ অধিকার সমন্ধে সচেতন থাকে ও অধিকার রক্ষার ব্যাপারে তৎপরতা সৃষ্টি হয়। প্রতারণা রোধ করাও এই আইনটির আর একটি উদ্দেশ্য। বিবাদের বিচার যত তাড়াতাড়ি হবে, খাঁটি সাক্ষ্য প্রমাণ তত বেশি পাওয়া সম্ভব। সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাঁটি সাক্ষ্য প্রমাণ তত বেশি পাওয়া অসম্ভব। সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাঁটি সাক্ষ্য-প্রমাণও অন্তর্নিহিত হতে থাকে। পরিণামে মিথ্যা এবং মেকী প্রমাণের আবির্ভাব ঘটতে পারে।
সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার আর একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে অনন্তকাল যেন বিবাদ চলতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে মামলা করার অধিকার নষ্ট হয়। তামাদি আইন, ১৯০৮ এর কিছু উদ্দেশ্য নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. অধিকারি ব্যক্তিদের অধিকার প্রদান ও আইনের সুবিধা প্রদান;
২. আইনগত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অপরের অবৈধ অধিকার বিনষ্ট;
৩. বিশৃঙ্খলা অবসানে সহযোগিতা;
৪. শান্তি প্রতিষ্ঠাতে সহযোগিতা;
৫. আইনগত ঝামেলায় পড়ার আশংকা রোধ;
৬. অধিকারি ব্যক্তিদের সমাজ জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান;
৭. মামলা দায়েরের অক্ষমতা সৃষ্টি করা;
৮. পুরাতন দাবি আদায়ে বাঁধা সৃষ্টি করা;
৯. বিলম্ব মার্জনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
১০. সুখাধিকার নিশ্চিত করা;
১১. তামাদির সময় গণনায় বিশেষ সুবিধা প্রদান করা;
১২. আদালতের সময়ের অপব্যবহার রোধ করা; এবং
১৩. মামলার পক্ষদ্বয়ের সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
উপরোক্ত যুক্তিসঙ্গত কারনেই তামাদি আইনকে সুবিচার শাস্তি ও আরামের আইন বলে গণ্য করা হয়। তামাদি আইনে প্রণীত বিধানসমূহের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে দূর-অতীতের কোন বিবাদীকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখার পথে অন্তরায়ের সৃষ্টি করা।
তামাদি আইন স্বয়ংসম্পূর্ণ আইন কি না
১৯০৮ সালের তামাদি আইনের সুস্পষ্ট বিধান হলো, এই আইনের নির্ধারিত সময়সীমার ভিতর কোন মোকদ্দমা, আপিল বা দরখাস্ত দাখিল না করলে পরবর্তীতে আদালতে সেগুলো গ্রহণযোগ্য হবে না। তামাদি আইনের ৩ ধারা হতে ২৫ ধারায় বর্ণিত সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী যে কোন ধরনের মোকদ্দমা, আপিল বা দরখাস্ত দাখিলের মেয়াদ সম্পর্কে সাধারণ নিয়ামাবলী ব্যতিক্রমসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে এই আইনের ৫ ধারায় তামাদি রেয়াত বা বিলম্ব মওকুফের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তামাদি আইনের ২৮ ধারায় জবরদখল বা বিরুদ্ধ দখলের দ্বারা সম্পত্তির মালিকানা স্বত্ব বিলুপ্ত হয় ও জবরদখলকারীর স্বত্ব অর্জনের সময়সীমা বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বিধানাবলী বর্ণিত রয়েছে। তদুপরি, ব্যবহারসিদ্ধ অধিকার অর্জনের সময়সীমা তামাদি আইনের ১৬ ও ২৭ ধারায় বিধানাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। উপরন্তু, এই আইনের ৫ ধারা মোতাবেক বিলম্ব মওকুফের যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছ উক্ত বিধান ছাড়া আদালত ন্যায় বিচারের স্বার্থে তামাদি আইন দ্বারা অনুমোদিত সময়সীমার ব্যাপারে কোন ধরনের অনুকম্পা বা ক্ষমা প্রদর্শন করবেন না।
সুতরাং যে দাবী বা অধিকার তামাদি হয়ে গেছে তার সময়সীমা বৃদ্ধি করার এখতিয়ার আদালতের নেই। এমনকি তামাদিকৃত দাবী বা অধিকারকে আদালত পুরুজ্জীবিত করতে পারবেন না। তবে তামাদি আইন বলতে এইরূপ এক স্বয়ংসম্পূর্ণ আইনকে বুঝায় যে, আইনের দ্বারা সর্ব প্রকার দাবী বা স্বত্বের দ্বন্দ্বকে অবিরাম গতিতে দীর্ঘায়িত করার সুযোগ না দিয়ে বরং তা চিরদিনের জন্য নিষ্পত্তিকল্পে সাহায্য করে থাকে। তাছাড়াও এই আইন প্রতারণামূলক কার্যক্রমকে প্রতিরোধ করে। তামাদি আইনের ২৯টি ধারা এবং ১নং তফসিলে ১৮৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে।
অতএব, এই আইনে সব ধরণের বিধিবদ্ধ নিয়মাবলী সন্নিবেশিত রয়েছে বিধায় একে স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধিবদ্ধ আইন বলে গণ্য।
Post a Comment
Post a Comment
To be published, comments must be reviewed by the administrator *