ব্রিটিশ শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পদ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। আইনি কাঠামো, ঐতিহাসিক নজির এবং অলিখিত কনভেনশনের সংমিশ্রণে এই গুরুত্বপূর্ণ পদটি শতাব্দী ধরে বিকশিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উপর বিস্তৃত দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, যার মধ্যে সরকারী বিষয়গুলির দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে ক্রাউনের প্রতিনিধিত্ব করা। এই গুরুত্বপূর্ণ পদটি শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি বা কনভেনশনের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। এই পদটির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। মর্লে (Lord Morley) বলেন-
Prime-minister is the key stone of the cabinet arch. He is central to its formation, central to its life and central to its death.
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। রাজা বা রাণী রাষ্ট্রের প্রধান; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দেশের সরকার প্রধান। বৃটেনের শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হল মন্ত্রিসভা বা মন্ত্রী পরিষদ। আর এই মন্ত্রিসভার কেন্দ্রবিন্দু হলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রকৃতপক্ষে, ব্রিটিশ কমন্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ব্যক্তিকে এই পদে নিয়োগদান করা হয়।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা ও ক্ষমতা
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলীকে মোটামুটিভাবে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলি নিম্নরূপ:
১. সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে;
২. সরকার প্রধান হিসেবে;
৩. কমন্স সভার নেতা হিসেবে;
৪. কেবিনেটের নেতা হিসেবে; এবং
৫. রাজা বা রাণীর পরামর্শ দাতা হিসেবে।
১. সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা
প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন কমন্স সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা হিসেবে তার মর্যদা অদ্বীয়। নিজ দলকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করার জন্য তাকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। দলের নেতা হিসেবে তার ব্যক্তিত্ব ও দক্ষতার উপর তার দলের বিজয় অনেকটা নির্ভরশীল। তাকে কেন্দ্র করেই দলের জনপ্রিয়তা ও স্থায়িত্ব গড়ে ওঠে।
২. সরকার প্রধান
সাধারণ নির্বাচনের পর কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে রাজা বা রাণী সরকার গঠন করার জন্য আহ্বান জানান। তিনি মন্ত্রী পরিষদের তালিকা প্রস্তুত করে রাজা বা রাণীর অনুমোদনের জন্য পেশ করেন। এই মন্ত্রী পরিষদই দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকেন। এরূপ গঠিত সরকারের প্রধান হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী।
৩. কমন্স সভার নেতা
কমন্স সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাই প্রধানমন্ত্রীর পদটি অলঙ্কৃত করেন এবং এই পদে অধিষ্ঠিত হবার পরও কমন্স সভার নেতার পদটি অক্ষুণ্ন থাকে।
কমন্স সভার সকল কার্য তার নির্দেশে এবং নিয়ন্ত্রনাধীনে সম্পন্ন হয়ে থাকে। তিনি নিজ দলের চীপ হুইপদের মাধ্যমে কার্য পরিচালনা করে থাকনে। কমন্স সভায় সকল গুরুত্বপূর্ণ বিল উত্থাপিত হয়। কাজেই দেশের জন্য সকল প্রকার আইন প্রণয়নে প্রধানমন্ত্রীকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে হয়। পার্লামেন্টে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমগ্র জাতির নিকট সরকারের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হয়।
৪. কেবিনেটের নেতা
কেবিনেটের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেবিনেট গঠন, পরিচালনা এবং ভেঙ্গে দিবার ব্যাপারে তার ক্ষমতা অপ্রতিরোধ্য।
কেবিনেটের সকল সদস্যকে তিনি মনোনয়ন করেন এবং বিভাগীয় মন্ত্রীদের কার্যাবলী তিনি তদারক করে থাকেন। মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর নিকট আপীল করা যায়। মন্ত্রীদের মধ্যে কোন মতবিরোধ দেখা দিলে তিনি মীমাংসা করে থাকেন। সুতরাং কোন মন্ত্রীর যদি তার সাথে মতবিরোধ হয়, তাহলে সেই মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়।
৫. রাজা বা রাণী পরামর্শদাতা
রাজা বা রাণীর নামে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা হয়ে থাকে এবং প্রতি ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাজা বা রাণী পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকেন। তিনি রাজা বা রাণী এবং কেবিনেটের মধ্যে যোগসূত্র সমন্বয় করেন।
কমন্স সভা ভেঙ্গে দেয়া, লর্ড সভার সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা, উপাধি বিতরণ, বিচারক নিয়োগ ইত্যাদি ব্যাপারে রাজা বা রাণীকে প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এছাড়া তিনি বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করে থাকেন এবং তার পরামর্শ মতই রাজা বা রাণী বিদেশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন।
এ সকল আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির অধিকারী। তাই ফাইনার (Finer) বলেন যে, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এত ক্ষমতার অধিকারী যে, পার্লামেন্টের সমর্থনে তিনি যা করতে পারেন তা জার্মান চ্যান্সেলরের পক্ষে সম্ভব নয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্টও তা পারেন না এবং সকল কমিটির সভাপতিগণও তা পারেন না। তবে এ সকল ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বহুলাংশে নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিত্বের উপর।
Post a Comment
Post a Comment
To be published, comments must be reviewed by the administrator *